পাহাড়ের জুমে সমভূমি তুলা (কার্পাস)
আবাদ ও ফলন বৃদ্ধির কৌশল
সুবীর কুমার বিশ্বাস
বাংলাদেশের তুলার উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক বুঝতে শিখেছে তুলা চাষের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলার নতুন জাত ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে সদা জাগ্রত বাংলার কৃষকের পাশে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক, যার প্রধান কাঁচামাল তুলা। তুলার দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাতে আমদানি ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খইল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। এই ভোজ্যতেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টরেল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫-২০% তেল পাওয়া যায়, যা সয়াবিন তেলের আমদানি ব্যয় কমাতে সক্ষম। খইলে রয়েছে উচ্চ প্রোটিন ২৪%, উচ্চফ্যাট ২০% এবং ক্রুড আঁশ ৪০%, যা পশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া তুলার পাতা মাটির জৈবসার বৃদ্ধিতে সহায়ক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল তুলা উৎপাদনের জন্য কার্পাস মহল হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে জমির উর্বরতা হ্রাস, পাহাড়ি জাতের তুলা বীজের কম ফলন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দিন দিন তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ের জুমে সমভূমি তুলা (কার্পাস) আবাদের ব্যবস্থা করেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ের জুমে এই জাতের তুলা উৎপাদনের মাধ্যমে ফলন অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই এই জাতের তুলা উৎপাদনের সঠিক ব্যবস্থাপনা জানা প্রয়োজন।
বপনের সময়
পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল/আগাছা পরিষ্কার করে তুলা বীজ বপন করা হয়। এপ্রিল ও মে মাসে পাহাড়ি তুলা এবং জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত আপল্যান্ড তুলার (সমভূমি তুলা) বীজ বপনের উপযোগী সময়। পর্যাপ্ত বৃষ্টির পর মাটির জো আর ঠা-া হলে পাহাড়ের ঢালে জুমে মে মাসেও তুলা বীজ বপন করা হয়। তবে আবহাওয়া ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাহাড়ের ঢালে জুমে চারা তৈরির মাধ্যমে তুলা চাষ করা যায়।
বপনের পদ্ধতি
একক ভাবে জুমে/ধানের সাথে/ছোট চারার ফলজ বনজ বাগানে তুলা ফসল আবাদ করা যায়। তাছাড়া বৃষ্টির পানি জমে না বা বন্যার পানি উঠে না এমন উঁচু জমি তুলা চাষের উপযোগী। জুমে ৩-৪ হাত দূরে লাইন দেওয়া যায়। সাধারণত একক তুলায় সমতলে/ পাহাড়ে দুই হাত (৯০ সেমি.) সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারা এক হাত (৪৫ সেমি.) দূরত্বে বপন করা হয়। তুলার বীজ মাটি সামান্য গভীরে (সর্বোচ্চ ১/৪ ইঞ্চি গভীর) বর্ষার ফাঁকে ফাঁকে বপন করতে হবে। বপন করার পর বীজ হালকা মাটি/জৈবসার দিয়ে ঢেকে দিলে চারা গজাতে সহজ হয়। দুই থেকে তিন দিন পর চারা গজায়।
পলিব্যাগে বা আম পাতা সেলাই করে (নারকেলের শালাকা দিয়ে), ছোট প্যাকে, ফেলে দেওয়া কাগজের কাপে চারা তৈরি করে ১৫-৩০ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করা যায়। তাছাড়া, নার্সারিতে চারা তৈরি করেও (মরিচ/বেগুন চারার ন্যায়) শিকড়ে ইকোস্প্রিন ১৫০ মিগ্রা. প্রতি লিটার পানিতে মাত্রায় আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে অপরাহ্নে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়।
সার ব্যবস্থাপনা
তুলা ফসলে সবটুকু রাসায়নিক সার একবারে প্রয়োগ না করে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য কয়েক কিস্তিতে (২-৪ কিস্তিতে) প্রয়োগ করা হয়। তুলা ফসলে রাসায়নিক সারের মাত্রা কানি (৪০ শতক) প্রতি ইউরিয়া : টিএসপি : এমওপি : জিপসাম : দস্তা : বোরন ৩০:৩৫:৪০:১৫:২:২ কেজি। জমিতে আগাছা হলে তা পরিষ্কার করে গাছের গোড়া থেকে প্রায় ৪ ইঞ্চি দূরে গর্তে ফাঁস (সার) দিতে হয়। তাছাড়া বিশেষজ্ঞগণ মতামত দেন যে, কানি (৪০ শতক) প্রতি ১৫-২০ মণ জৈবসার (কম্পোস্ট বা গোবর বা পোলট্রি লিটার সার বা কেঁচো সার ইত্যাদি) প্রয়োগে রাসায়নিক সার কম লাগে এবং মাটির স্বাস্থ্য ও পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। অতঃপর গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং জঙ্গল/খড়কুটা দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি ঢেকে দিতে হবে (জৈব মালচিং)। এতে সার (ফাস) ও মাটি ধুয়ে যায় না, তুলা গাছের খুব উপকার হয়।
বালাই ব্যবস্থাপনা
জাব, জ্যাসিড, থ্রিপস প্রভৃতি পোকা দমনের জন্য কনফিডর/ইমিটাফ/ফটিক ৭০ ডব্লিউডিজি ৪ গ্রাম প্রতি ১৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে চিবিয়ে খাওয়া পোকা দমনের জন্য “হাত বাছাই” এর পর লিবসেন/ট্রেসার অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স সাধারণত ৬০-৭০ দিন হলে ৩য় কিস্তির সার (ফাস) প্রয়োগ করতে হবে এবং সাধারণত ৮০-৯০ দিন বয়স হলে গাছের শীর্ষ ডগা ভেঙ্গে দেয়া যায়।
গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে ২য় কিস্তির ফাস প্রয়োগের পর ফসলের অবস্থা বুঝে (যদি বাড় বাড়তি ভালো হয়) তবে গাছ খাটো রাখতে “রূপালী বাম্পার”(ম্যাপিকুয়েট ক্লোরাইড) প্রয়োগ করতে হবে ১-১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে। আর বাড়-বাড়তি সতেজ রাখতে ফ্লোরা পিজিআর প্রয়োগ করা ভালো। তাছাড়া, লাগাতার ঝড় বৃষ্টির মধ্যে (সাধারণত সেপ্টেম্বর- নভেম্বর মাস) আগাম চাষকৃত তুলা ফসলের কুঁড়ি-ফুল-ফল ঝরে পড়া রোধে ঝড় বৃষ্টির আগে একবার এবং ঝড়-বৃষ্টির পরে আরও একবার প্লানোফিক্স/ক্রপসকেয়ার/সুপারফিক্স পিজিআর প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলি মাত্রায় মিশিয়ে বিকেলে বা ঠা-া আবহাওয়ায় স্প্রে করতে হবে।
তুলা গাছের স্বাভাবিক ফলন বৃদ্ধির জন্য ১৬টি ফল ধারণ শাখার উপর থেকে তুলা গাছের মাথা কেটে দিতে হয়। এই ডিটপিং প্রক্রিয়া তুলার ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ তুলা ফসলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়। গাছের পরিস্থিতি, আবহাওয়া, মাটির অবস্থা অনুসারে সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ প্রয়োগ করলে খরচ কম হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। এতে কৃষক অধিক লাভবান হতে পারে।
তুলা উত্তোলন
সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে তুলা উত্তোলন শুরু হয়। ঠা-া ও শুকনা অবস্থায় তুলা তুলতে হয়। ভেজা তুলা তুললে তা ওজনে কমে যায়। বৃষ্টির পর তুলা উত্তোলন করা ঠিক না। সাধারণত বৃষ্টি হলে এরপর ২-৩ দিন রোদে তুলা শুকালে উত্তোলন শুরু করতে হয়। এতে তুলা উত্তোলনও সহজ হয় এবং সময় কম লাগে। তুলা উত্তোলনের পর পরিবহনের জন্য জিনার কর্তৃক বস্তা সরবরাহ করা হয়। উত্তোলনকৃত তুলা বস্তায় সংরক্ষণ করা হয় এবং জিনারের নিকট বিক্রয় করা হয়। সাধারণত একই মাঠ থেকে মোট তিনবার তুলা উত্তোলন করা হয়।
তুলা বাজারজাতকরণ
যেকোন ফসলের বাজারজাতকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক বাজার ব্যবস্থার অভাবে কৃষক ঐ ফসলে চাষের আগ্রহ হারায়। এক্ষেত্রে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের চেষ্টায় তুলার বাজারজাতকরণ সবচেয়ে কৃষকবান্ধব। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে সারাদেশে তুলার এক মূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং কৃষক থেকে জিনার সরাসরি তুলা ক্রয় করে থাকে। এক্ষেত্রে কোন মধ্যস্বত্বভোগীর অবস্থানের সুযোগ নেই।
সতর্কতা
রূপালী বাম্পার কেবল মাত্র মাঠ কর্মীর উপস্থিতি/ অনুমোদন ক্রমে ব্যবহার করতে হবে। কনফিডর/ ফটিক বার বার প্রয়োগ না করে গাছের বয়স ৭০-৮০ দিনের পর জ্যাসিডের আক্রমণ বেশি হলে অন্য গ্রুপের কীটনাশক পেগাসাস প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মাত্রায় একবারই মাত্র প্রয়োগ করতে হবে। (পেগাসাস বার বার ব্যবহার করলে গাছের আগা শুকিয়ে যায় ও ফুল-ফল ভালো হয় না)। জমিতে রসের অভাব দেখা মাত্র পানি তুলে দিতে হবে। ঠা-া ও শুকনা তুলা মাঠ থেকে তুলতে হবে। পোকা রোগাক্রান্ত ও দাগযুক্ত ও অর্ধ ফুটন্ত তুলা আলাদা তুলতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হয়, অতিরিক্ত ইউরিয়া তুলা গাছের জন্য ক্ষতিকর। এমওপি সার ইউরিয়া থেকে বেশি ব্যবহার করতে হয়। চারা গাছে রাসায়নিক সার তুলনামূলক কম ব্যবহার করে পরবর্তীতে সার ব্যবহার আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দিতে হয়।
সাথী ফসল
তুলার সাথে ধান, লালশাক, মুলা, বরবটি, ভুট্টা, ধনিয়া, পাট, হলুদ, মরিচ, পিয়াজ, গীমাকলমী, মুগ, মারফা ইত্যাদি সাথী ফসল হিসেবে এবং আইল ফসল হিসেবে কুমড়া, শিম, ঝিঙা, করলা ইত্যাদি আবাদ করা যায়। এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের সাথে সাথে কৃষক অধিক লাভবান হতে পারে। এ ছাড়া সাথী ফসল চাষের ফলে আগাছা নিয়ন্ত্রণের খরচ অনেক কমে যায়। সাথী ফসল চাষের ফলে জমিতে আগাছা কম হয়।
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা বহুকাল ধরে অবহেলিত ছিল। পশ্চাৎপদ এই জনগোষ্ঠী বহুকাল ধরে আধুনিকতা থেকে ছিল অনেক দূরে। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতি নানা কারণে তাদের উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। দিন বদলের স্লোগান নিয়ে সরকার এগিয়ে এসেছে পাহাড়ি এলাকার জনগণের পাশে। আর সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে তুলা উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ের মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য পাহাড়ের ঢালে সমভূমি তুলা (কার্পাস) চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই জাতের তুলা আবাদের মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকার কৃষকগণ আর্থিকভাবে সাবলম্বী হতে পারবে।
লেখক : তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, আঞ্চলিক কার্যালয়, চট্টগ্রাম। মোবাইল : ০১৭৪৭১৬৫০৬৯, ই-মেইল : cdoctg@cdb.gov.bd